নির্বাচন ফেব্রুয়ারির মধ্যে না হলে দেশ কি সংকটে পড়বে?
নির্বাচন যে কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণের মতামত প্রকাশের অন্যতম প্রধান মাধ্যম। বাংলাদেশে নির্বাচন নিয়ে সবসময়ই রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তেজনা দেখা যায়। বিশেষ করে জাতীয় সংসদ নির্বাচন সময়মতো অনুষ্ঠিত হবে কি না, তা নিয়ে সাধারণ মানুষ, রাজনৈতিক দল, ব্যবসায়ী মহল এবং আন্তর্জাতিক মহল সবই উদ্বিগ্ন থাকে। যদি ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হয়, তবে দেশ একটি বড় ধরনের রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংকটে পড়তে পারে। এই সংকটকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করা যায়।
প্রথমত, সাংবিধানিক সংকট দেখা দিতে পারে। সংবিধান অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করতে হয়। সময়মতো নির্বাচন না হলে সংসদের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে এবং সরকারের বৈধতা হারানোর ঝুঁকি দেখা দেয়। জনগণের চোখে একটি অনির্বাচিত সরকার টিকে থাকলে তা গণতন্ত্রের মৌলিক কাঠামোকে দুর্বল করবে।
দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা প্রবল। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে আমরা দেখেছি যে, নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন না হলে আন্দোলন, বিক্ষোভ এবং সহিংসতা বাড়তে থাকে। বিরোধী দলগুলো দাবি তুলতে পারে যে সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে নির্বাচন পিছিয়ে দিয়ে ক্ষমতায় থাকতে চাইছে। এর ফলে রাস্তাঘাটে সংঘর্ষ, অবরোধ, হরতাল এবং আইনশৃঙ্খলার অবনতি দেখা দিতে পারে। এতে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা ব্যাহত হবে এবং অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
তৃতীয়ত, অর্থনৈতিক সংকট তীব্রতর হতে পারে। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা দ্বিধাগ্রস্ত হবে এবং অনেক ক্ষেত্রে বিনিয়োগ স্থগিত করবে। অভ্যন্তরীণভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পকারখানা, আমদানি-রপ্তানি সব কিছুতেই ধস নামতে পারে। কর্মসংস্থানের সুযোগ হ্রাস পাবে এবং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেতে পারে। অর্থনৈতিক চাপ সরাসরি জনগণের জীবনযাত্রায় প্রভাব ফেলবে।
চতুর্থত, আন্তর্জাতিক চাপ ও কূটনৈতিক সংকট তৈরি হতে পারে। বাংলাদেশে নির্বাচন সময়মতো না হলে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত বিশ্বের দেশগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করতে পারে। তারা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ওপর জোর দিয়ে কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে, এমনকি নিষেধাজ্ঞার কথাও আসতে পারে। এর ফলে বাংলাদেশের বৈদেশিক সম্পর্ক ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
পঞ্চমত, জনগণের আস্থা হারানোর ঝুঁকি অত্যন্ত বড়। জনগণ যদি মনে করে যে তাদের ভোটাধিকারকে অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে, তবে রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতি আস্থা দুর্বল হয়ে পড়বে। গণতন্ত্রে জনগণের অংশগ্রহণই মূল শক্তি, আর নির্বাচন সেই অংশগ্রহণের প্রধান হাতিয়ার। সময়মতো নির্বাচন না হলে মানুষের মধ্যে হতাশা, ক্ষোভ এবং বিক্ষোভ দানা বাঁধতে পারে।
তবে এ অবস্থার কিছু ইতিবাচক সমাধানের পথও আছে। সরকার এবং বিরোধী দলগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক সংলাপ জরুরি। নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষ ও স্বাধীনভাবে কাজ করতে হবে যাতে সবাই আশ্বস্ত হয়। তাছাড়া আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের উপস্থিতি নির্বাচনকে স্বচ্ছতা দিতে পারে।
সর্বোপরি বলা যায়, ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন না হলে দেশ বহুমুখী সংকটে পড়তে পারে—সাংবিধানিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক এবং সামাজিক সব দিক থেকেই। তাই সময়মতো অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন করা শুধু রাজনৈতিক প্রয়োজন নয়, বরং জাতীয় স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত জরুরি। গণতন্ত্রের মূল চাবিকাঠি হলো নির্বাচন, আর সেটি যদি যথাসময়ে না হয় তবে রাষ্ট্রব্যবস্থা পুরোপুরি ঝুঁকির মুখে পড়তে বাধ্য।
উপসংহার
ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন না হলে দেশ সাংবিধানিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক এবং সামাজিক সংকটে পড়তে বাধ্য। তাই সময়মতো অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন শুধু রাজনৈতিক দায়িত্ব নয়, বরং জাতীয় স্থিতিশীলতা ও টেকসই উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। গণতন্ত্রের প্রাণ হলো নির্বাচন, আর সেই নির্বাচন যদি যথাসময়ে না হয় তবে রাষ্ট্রব্যবস্থা পুরোপুরি ঝুঁকির মুখে পড়বে।
.jpg)
0 মন্তব্যসমূহ