Header Ads Widget

Responsive Advertisement

বাংলাদেশে মবের রাজনীতির ভবিষ্যৎ: গণতন্ত্রের জন্য আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ?


🇧🇩 বাংলাদেশে মবের রাজনীতির ভবিষ্যৎ: গণতন্ত্রের জন্য আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ?



বাংলাদেশের রাজনীতিতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে “মব রাজনীতি” বা জনতার আবেগনির্ভর রাজনীতির একটি নতুন ধারা দেখা যাচ্ছে। আগে রাজনীতি ছিল নেতৃত্ব, সংগঠন ও আদর্শের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা একটি প্রক্রিয়া। কিন্তু এখন তা অনেকাংশে পরিণত হয়েছে জনতার আবেগ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাব এবং তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার রাজনীতিতে। প্রশ্ন হলো—এই মব রাজনীতি কি গণতন্ত্রের জন্য শুভ, নাকি এটি ভবিষ্যতের জন্য এক অন্ধকার সতর্কবার্তা?

🔹 মব রাজনীতি কী এবং কেন এটি বৃদ্ধি পাচ্ছে

‘মব রাজনীতি’ বলতে বোঝায় এমন এক রাজনৈতিক অবস্থা, যেখানে নীতি, আদর্শ বা যুক্তির পরিবর্তে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতার আবেগ ও উত্তেজনা প্রাধান্য পায়। এতে সংগঠিত নেতৃত্বের পরিবর্তে জনতার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যেমন ফেসবুক, ইউটিউব বা টিকটক এই প্রবণতাকে আরও উসকে দিচ্ছে।

আজকাল কোনো রাজনৈতিক বা সামাজিক ইস্যু উঠলেই মুহূর্তের মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় তা ভাইরাল হয়। ফলে, নেতৃত্ব না থাকলেও মব তৈরি হয়, আর এই মবই রাজনীতির মাঠে বা রাস্তায় প্রভাব বিস্তার করে।

🔹 বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মব রাজনীতির উত্থান

বাংলাদেশের ইতিহাসে গণআন্দোলনের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গৌরবময়—ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন—সবই জনগণের শক্তির ফল। কিন্তু সেই আন্দোলনগুলো ছিল সংগঠিত ও নেতৃত্বনির্ভর। বর্তমান যুগে সেই নেতৃত্বপ্রবণতা দুর্বল হয়ে পড়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোতে আদর্শের চেয়ে ক্ষমতা ও পৃষ্ঠপোষকতার রাজনীতি বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

ফলে সাধারণ জনগণের মধ্যে হতাশা ও অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে। এই শূন্যতার সুযোগ নিচ্ছে মব পলিটিক্স বা জনতার আবেগের রাজনীতি। এখন মানুষ নেতৃত্বের অপেক্ষা না করে, নিজের রাগ বা ক্ষোভের প্রকাশেই রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া দেখায়।

🔹 সোশ্যাল মিডিয়া: নতুন রাজনৈতিক মঞ্চ

ফেসবুক, টুইটার, টিকটক ও ইউটিউব এখন রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের অন্যতম হাতিয়ার। এখানে কোনো খবর বা ভিডিও মুহূর্তে ভাইরাল হয়, অথচ তথ্যের সত্যতা যাচাই করার সুযোগ থাকে না। ফলে অনেক সময় গুজব, অপপ্রচার ও মিথ্যা তথ্য জনতাকে উত্তেজিত করে তোলে।

যে ইস্যু আগে সীমিত আকারে আলোচিত হতো, এখন সেটি কয়েক ঘণ্টার মধ্যে জাতীয় ইস্যুতে পরিণত হয়। রাজনীতিবিদরা বুঝতে পারছেন, প্রচলিত সভা-মিছিলের চেয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় কয়েক মিনিটের বক্তব্যই এখন জনমত তৈরিতে বেশি কার্যকর।

🔹 মব রাজনীতির ক্ষতিকর দিক

মব রাজনীতি গণতন্ত্রের মৌলিক কাঠামোকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে। এর কয়েকটি বড় ক্ষতি হলো—


1. গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি দুর্বল হয়ে পড়ে, কারণ মানুষ ভোট ও আইনি প্রক্রিয়ার ওপর আস্থা হারায়।

2. আইনের শাসন বিপন্ন হয়, কারণ জনতা নিজেরাই বিচার করতে চায়, যা কখনো কখনো সহিংসতায় রূপ নেয়।

3. নেতৃত্বের মর্যাদা কমে যায়, কারণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা চলে যায় আবেগনির্ভর ভিড়ের হাতে।

4. রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়, কারণ গুজব ও আবেগের রাজনীতি প্রশাসনিক কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করে।

বাংলাদেশে ইতিমধ্যেই দেখা গেছে, সামাজিক মাধ্যমে ছড়ানো গুজব থেকে শুরু করে রাজনৈতিক সমাবেশে উত্তেজনা—সবই অনেক সময় সহিংসতায় পরিণত হয়েছে। এগুলো ভবিষ্যতের জন্য বড় সতর্কবার্তা।


🔹 ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা


বাংলাদেশে মব রাজনীতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে তিনটি মূল বিষয়ের ওপর:

(১) রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব ও সংগঠনের শক্তি,

(২) তরুণ সমাজের রাজনৈতিক সচেতনতা,

(৩) গণমাধ্যম ও শিক্ষাব্যবস্থার দায়িত্বশীলতা।


যদি দলগুলো আদর্শভিত্তিক নেতৃত্ব তৈরি করতে পারে, তবে মব রাজনীতি যুক্তিনির্ভর গণআন্দোলনে রূপ নিতে পারে। আবার যদি তরুণরা শিক্ষা ও সচেতনতার মাধ্যমে নিজেরাই তথ্য যাচাই করতে শেখে, তাহলে আবেগ নয়, যুক্তিই হবে রাজনীতির ভিত্তি।


অন্যদিকে, যদি বর্তমান প্রবণতা অব্যাহত থাকে—যেখানে সোশ্যাল মিডিয়া নেতৃত্বের চেয়ে শক্তিশালী—তাহলে রাজনীতি ধীরে ধীরে গণতন্ত্র থেকে আবেগের রাজনীতিতে পরিণত হবে। তখন রাজনীতি হবে প্রতিক্রিয়ার, নয় পরিকল্পনার।

🔹 উপসংহার


বাংলাদেশে মব রাজনীতি এখন এক বাস্তবতা। এটি জনগণের শক্তির প্রতিফলন হলেও, নিয়ন্ত্রণহীন আবেগ যখন যুক্তির স্থান দখল করে, তখন গণতন্ত্র বিপদের মুখে পড়ে। ভবিষ্যতের রাজনীতি টিকিয়ে রাখতে হলে প্রয়োজন সচেতন নাগরিক, দায়িত্বশীল নেতৃত্ব এবং স্বাধীন গণমাধ্যম।

মব রাজনীতি যদি ইতিবাচক পথে পরিচালিত হয়, তাহলে এটি জনতার কণ্ঠস্বর হতে পারে; আর যদি তা উগ্রতা ও গুজবনির্ভর পথে যায়, তবে এটি রাষ্ট্রের জন্য এক বড় সংকট হয়ে উঠবে।

বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ তাই নির্ভর করছে — আমরা কি আবেগের রাজনীতি থেকে যুক্তির রাজনীতিতে ফিরতে পারব কিনা।

আরও পড়তে ক্লিক করুন 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ