বিরল রোগ সন্তান অচল হয়ে পড়লেও কিছু করার থাকে না মা–বাবার
মানুষের জীবনে সন্তানের চেয়ে মূল্যবান আর কিছু নেই। কিন্তু যদি হঠাৎ কোনো বিরল রোগে আক্রান্ত হয়ে শিশু ধীরে ধীরে অচল হয়ে পড়ে, তখন মা–বাবার মানসিক কষ্টের কোনো ভাষা থাকে না। বিরল রোগগুলোর মধ্যে অনেকগুলো এমন রয়েছে, যা শিশুর শরীরের পেশী, স্নায়ু বা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে ধীরে ধীরে অক্ষম করে দেয়। ফলে সুস্থভাবে জন্ম নেওয়া সন্তান হঠাৎ একসময় হাঁটতে, দৌড়াতে বা খেলতে অক্ষম হয়ে পড়ে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এই রোগগুলোর নাম জানা থাকলেও কার্যকর ও সহজলভ্য চিকিৎসা প্রায় নেই বললেই চলে।
বিরল রোগের প্রকৃতি ও উদাহরণ
শিশুদের মধ্যে দেখা দেওয়া বিরল রোগের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত হলো ডুশেন মাসকুলার ডিসট্রফি (DMD)। এ রোগে পেশীর শক্তি ধীরে ধীরে কমে যায়। সাধারণত ৩ থেকে ৫ বছর বয়সে এর লক্ষণ দেখা দেয়। শিশু আগে ভালোভাবে হাঁটতে পারলেও হঠাৎ পড়ে যায়, দৌড়াতে পারে না, সিঁড়ি ভাঙতে কষ্ট হয়। ১০-১২ বছর বয়সের মধ্যে তারা হুইলচেয়ারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। আরেকটি হলো স্পাইনাল মাসকুলার অ্যাট্রোফি (SMA), যেখানে স্নায়ুর দুর্বলতার কারণে পেশী নষ্ট হয় এবং শিশুদের শরীর ধীরে ধীরে অচল হয়ে যায়।
মা–বাবার অসহায়ত্ব
যখন সন্তান ধীরে ধীরে অচল হয়ে পড়ে, তখন মা–বাবা দিনরাত হাসপাতালে দৌড়ান। শুরুতে তারা ভেবে নেন হয়তো ভিটামিন বা সাধারণ চিকিৎসায় সেরে উঠবে। কিন্তু যখন ডাক্তাররা জানান এটি একটি বিরল রোগ, তখন তাদের ওপর আকাশ ভেঙে পড়ে। চিকিৎসার খরচ এত বেশি যে সাধারণ পরিবার তা বহন করতে পারে না। অনেক সময় কোনো ওষুধ বা চিকিৎসা পদ্ধতিই দেশে পাওয়া যায় না। ফলে মা–বাবা অসহায়ের মতো চোখের সামনে সন্তানের চলাফেরার ক্ষমতা হারিয়ে যেতে দেখেন।
চিকিৎসার সীমাবদ্ধতা
বিরল রোগ নিয়ে চিকিৎসা বিশ্বব্যাপী এখনো গবেষণার পর্যায়ে। যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপে কিছু উন্নত ওষুধ তৈরি হলেও সেগুলোর দাম কোটি টাকারও বেশি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, SMA রোগের জন্য ব্যবহৃত “Zolgensma” ওষুধের দাম প্রায় ২০ লাখ মার্কিন ডলার, যা বিশ্বের সবচেয়ে দামী ওষুধ হিসেবে পরিচিত। উন্নয়নশীল দেশের সাধারণ পরিবারের জন্য এ চিকিৎসা কল্পনাতীত। ফলে অভিভাবকদের কোনো বিকল্প থাকে না।
সামাজিক ও মানসিক প্রভাব
শুধু চিকিৎসা নয়, সামাজিকভাবেও বিরল রোগে আক্রান্ত শিশু ও তাদের পরিবার বৈষম্যের শিকার হয়। স্কুলে অনেক সময় তাদের গ্রহণ করা হয় না, খেলাধুলায় অংশ নিতে পারে না। মা–বাবা সন্তানকে নিয়ে আত্মীয়স্বজন বা প্রতিবেশীর কাছে গেলে অনেকেই করুণা বা অবহেলার দৃষ্টিতে তাকায়। এতে শিশুদের মানসিক আঘাত লাগে এবং পরিবারও এক ধরনের একাকিত্বে ভোগে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশে বিরল রোগ শনাক্তকরণ এবং চিকিৎসা এখনো সীমিত পর্যায়ে। বেশিরভাগ চিকিৎসক প্রাথমিক পর্যায়ে এসব রোগ সনাক্ত করতে পারেন না। গবেষণা ও ওষুধ উৎপাদনের উদ্যোগও নেই বললেই চলে। কিছু পরিবার বিদেশে চিকিৎসার জন্য চেষ্টা করলেও ব্যয়ভার বহন করতে গিয়ে অনেকে সর্বস্বান্ত হয়ে যায়। সরকার ও সমাজের সম্মিলিত উদ্যোগ ছাড়া এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।
করণীয়
১. সচেতনতা বৃদ্ধি – বিরল রোগ সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে জানাতে হবে।
২. গবেষণা ত্বরান্বিত করা – সরকারি-বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিশেষ তহবিল দিতে হবে।
৩. চিকিৎসা সহজলভ্য করা – আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে দামি ওষুধ সহজলভ্য করতে হবে।
৪. সামাজিক সহায়তা – আক্রান্ত পরিবারকে মানসিক ও আর্থিক সহায়তা দিতে হবে।
বাস্তব উদাহরণ: ঢাকার এক পরিবার
ঢাকার উত্তরাঞ্চলের একজন বাবা জানিয়েছেন, তার চার বছরের ছেলে প্রথমে হাঁটতে সমস্যা দেখায়। প্রথমে ভেবেছিলেন, হয়তো শিশুটি একটু দেরিতে শিখছে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ছেলে দৌড়াতে পারছিল না, সিঁড়ি ভাঙতে কষ্ট হচ্ছিল। হাসপাতালে গেলে ডাক্তাররা জানান, শিশু ডুশেন মাসকুলার ডিসট্রফি (DMD) নামে একটি বিরল জিনগত রোগে আক্রান্ত। বাবা বলেন, “আমরা চোখের সামনে দেখি ছেলে ক্রমে অচল হয়ে যাচ্ছে, অথচ কিছু করার ক্ষমতা আমাদের নেই। চিকিৎসা এত ব্যয়বহুল যে আমরা সামলাতে পারছি না।”
আরেকটি উদাহরণ ময়মনসিংহ থেকে এসেছে। এক দম্পতি তাদের সদ্য জন্মানো সন্তানের হাড় দুর্বলতা লক্ষ্য করে ডাক্তারকে দেখান। পরীক্ষা শেষে জানা যায়, শিশু স্পাইনাল মাসকুলার অ্যাট্রোফি (SMA) রোগে আক্রান্ত। চিকিৎসকেরা বলেন, “বিশেষ ওষুধ বিদেশে আছে, তবে দাম কোটি টাকা।” পরিবারটি এমন ব্যয়ভার বহন করতে পারছিল না। সন্তান ধীরে ধীরে হুইলচেয়ারে নির্ভরশীল হয়ে যায়।
বিরল রোগের প্রকৃতি
বিরল রোগের মধ্যে অনেকই জিনগত বা অনुवংশিক। শিশু প্রথমে সুস্থ জন্মায়, কিন্তু ধীরে ধীরে অক্ষম হয়ে যায়। এ ধরনের রোগের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত হলো:
ডুশেন মাসকুলার ডিসট্রফি (DMD): শিশুদের পেশী দুর্বল করে।
স্পাইনাল মাসকুলার অ্যাট্রোফি (SMA): স্নায়ু সমস্যার কারণে পেশী নষ্ট হয়।
প্রোজেরিয়া: দ্রুত বার্ধক্যজনিত লক্ষণ দেখা দেয়।
মা–বাবার অসহায়ত্ব
যখন সন্তান ধীরে ধীরে অচল হয়ে পড়ে, তখন মা–বাবা মানসিক ও আর্থিক চাপের মধ্যে পড়েন। অনেক সময় ডাক্তাররা শুধু রোগের নাম জানিয়ে দেন, কিন্তু কার্যকর ও সহজলভ্য চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। বাংলাদেশে বিরল রোগের জন্য পর্যাপ্ত ওষুধ, চিকিৎসা কেন্দ্র বা গবেষণা নেই। ফলে পরিবারগুলো প্রায়শই বিদেশের চিকিৎসার ওপর নির্ভরশীল হয়, যা তাদের জন্য অসম্ভব ব্যয়বহুল।
সামাজিক ও মানসিক প্রভাব
শিশুদের স্কুল বা খেলার মাঠে অন্যান্য শিশুদের সঙ্গে মিশতে সমস্যা হয়। পরিবারগুলো প্রায়ই আত্মীয়-স্বজন ও সমাজের কাছ থেকে কম সহায়তা পায়। এই ধরনের পরিস্থিতি পরিবারে মানসিক চাপ বৃদ্ধি করে। অনেক মা–বাবা জানান, তারা দিনের পর দিন ঘুম-খাওয়া ভুলে গিয়ে শুধু সন্তানের যত্নে মনোনিবেশ করেন।
কর
ণীয়
১. সচেতনতা বৃদ্ধি: সমাজকে বিরল রোগ সম্পর্কে জানাতে হবে।
২. গবেষণা ও ওষুধ উন্নয়ন: সরকার ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে উদ্যোগ নিতে হবে।
৩. আর্থিক সহায়তা: বিরল রোগে আক্রান্ত পরিবারগুলোর জন্য তহবিল ও সস্তা চিকিৎসা ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে।
৪. মানসিক সহায়তা: পরিবার ও শিশুর জন্য মানসিক সহায়তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
উপসংহার
বিরল রোগে আক্রান্ত একটি শিশু মানে শুধু একজন রোগী নয়, বরং একটি পুরো পরিবারকে জীবনের কঠিন পরীক্ষায় ফেলে দেওয়া। মা–বাবা চোখের সামনে সন্তানের জীবন অচল হয়ে যেতে দেখলেও কিছুই করার থাকে না। এটি শুধু একটি চিকিৎসা সমস্যা নয়, বরং মানবিক দায়িত্বও বটে। তাই রাষ্ট্র, সমাজ ও বিশ্বকে একসঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে, যাতে কোনো মা–বাবাকে আর এ অসহায় দৃশ্য দেখতে না হয়।

0 মন্তব্যসমূহ