বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের দুশ্চিন্তার কারণ: একটি বিস্তৃত বিশ্লেষণ
দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের ইতিহাস, সীমান্ত, অর্থনীতি ও নিরাপত্তা—সব মিলিয়ে বহুমাত্রিক। দুই দেশই ঘনিষ্ট প্রতিবেশী, এবং নানা সময়ে সহযোগিতা ও উত্তেজনা—দুই পরিস্থিতিই দেখা গেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আঞ্চলিক ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও বিশ্ব রাজনৈতিক পরিবর্তন ভারতের জন্য কিছু দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে। এই দুশ্চিন্তা মূলত নিরাপত্তা, অর্থনীতি, কূটনীতি ও আঞ্চলিক প্রভাবের ভারসাম্যকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।
১. ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা ও চীনের প্রভাব বৃদ্ধি
ভারতের অন্যতম বড় উদ্বেগ হলো বাংলাদেশে চীনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব দ্রুত বাড়ছে। চীন বাংলাদেশের অবকাঠামো খাতে বিশাল বিনিয়োগ করছে—বন্দর, সড়ক, রেল, বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ অনেক প্রকল্পে তারা জড়িত। এর ফলে ভারত আশঙ্কা করে যে বাংলাদেশ তার ঐতিহ্যগত কূটনৈতিক অবস্থান থেকে সরে গিয়ে চীনের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়তে পারে।চীন বাংলাদেশকে সামরিক সরঞ্জামও সরবরাহ করছে, যা ভারতের নিরাপত্তা মানচিত্রে বিশেষ গুরুত্ব পায়। ভারত মনে করে, যদি চীনের সামরিক প্রভাব বাংলাদেশে আরও গভীর হয়, তাহলে ভারত-চীন প্রতিদ্বন্দ্বিতার একটি নতুন অধ্যায় দক্ষিণ এশিয়াতেই তৈরি হতে পারে।
২. সীমান্ত নিরাপত্তা, অনুপ্রবেশ ও বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত বিশ্বের অন্যতম দীর্ঘ সীমান্ত। এই বিশাল সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ করা ভারতের জন্য সবসময়ই চ্যালেঞ্জ। অনুপ্রবেশ, চোরাচালান, মানব পাচার, মাদক পাচার—এই সব কিছুর কারণে ভারত উদ্বিগ্ন থাকে। বিশেষত অসম, ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার উপর এর প্রভাব পড়ে।অতীতে উত্তর-পূর্ব ভারতের কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী বাংলাদেশে আশ্রয় পেত—যদিও সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ সরকার কঠোর অবস্থান নিয়েছে। তবুও ভারত মনে করে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়লে সীমান্ত আবারও অস্থিতিশীল হতে পারে।
৩. রোহিঙ্গা সংকটের আঞ্চলিক প্রভাব
মায়ানমারের সামরিক নিপীড়নে বাংলাদেশে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা এসেছে। এই বিশাল মানবিক সঙ্কট বাংলাদেশের অর্থনীতি, পরিবেশ ও নিরাপত্তায় চাপ তৈরি করেছে। ভারত আশঙ্কা করে, রোহিঙ্গারা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে প্রবেশ করতে পারে, যা সেখানে জনসংখ্যার ভারসাম্য, নিরাপত্তা ও সন্ত্রাসবাদের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।এছাড়া রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক চাপ এবং মায়ানমারের সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখাও ভারতের জন্য কৌশলগত চ্যালেঞ্জ।
৪. নদী ও পানি বণ্টন নিয়ে বিবাদ
গঙ্গা, তিস্তা ও অন্যান্য যৌথ নদীর পানিবণ্টন দুই দেশের সম্পর্কে বহুদিন ধরেই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। তিস্তা চুক্তি এখনও চূড়ান্ত না হওয়ায় বাংলাদেশে ক্ষোভ রয়েছে এবং এর রাজনৈতিক প্রভাবও আছে। ভারত মনে করে পানি ইস্যুতে সম্পর্কের অবনতি হলে উভয় দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও তার প্রভাব পড়তে পারে।পানিবণ্টন নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকলে সীমান্ত এলাকার কৃষি, জনজীবন ও কূটনৈতিক সম্পর্ক দুই দেশেই চাপে পড়ে।
৫. বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার প্রভাব
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অস্থিরতা ভারতের জন্য আরেক বড় উদ্বেগ। নির্বাচন, প্রতিবাদ, সহিংসতা—সব মিলিয়ে বাংলাদেশের ভেতরের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হলে ভারতের সীমান্ত এলাকায় তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়ে। অনেকে শরণার্থী হিসেবে সীমান্তে আসার চেষ্টা করতে পারে, আবার দুষ্কৃতিকারীরা সুযোগ নিতে পারে।ভারত চায় বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকুক, কারণ স্থিতিশীল প্রতিবেশীই নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করে।
৬. বাণিজ্য ভারসাম্য ও অর্থনৈতিক নির্ভরতা
বাংলাদেশ ভারতের একটি বড় বাণিজ্যিক বাজার। ভারত উদ্বিগ্ন থাকে যে আঞ্চলিক বা বৈশ্বিক রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশ যদি অন্য দেশের (চীন, তুরস্ক, রাশিয়া) দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ে, তাহলে ভারতের অর্থনৈতিক স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। আবার বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হলে ভারতের সীমান্ত বাণিজ্য ও আঞ্চলিক ব্যবসায়িক পরিবেশ অস্থিতিশীল হতে পারে।
৭. পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তর-পূর্ব ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির প্রভাব
বাংলাদেশ সম্পর্ক ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও বড় ভূমিকা রাখে, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে। নাগরিকত্ব আইন, NRC, অবৈধ অনুপ্রবেশ ইস্যু এসব জটিলতা দুই দেশের সম্পর্কে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে। বাংলাদেশে কোনো রাজনৈতিক পরিবর্তন বা সীমান্তে উত্তেজনা হলেই ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তার সরাসরি প্রভাব দেখা যায়।
উপসংহার
বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের দুশ্চিন্তা কোনো একক কারণে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি ভূরাজনীতি, অর্থনীতি, নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক সম্পর্কের জটিল সমন্বয়। চীনের প্রভাব বৃদ্ধি, সীমান্ত নিরাপত্তা, রোহিঙ্গা সংকট, পানিবণ্টন, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা—সব মিলিয়ে ভারত চায় বাংলাদেশ যেন একটি স্থিতিশীল, সহযোগিতামূলক এবং কৌশলগতভাবে নির্ভরযোগ্য প্রতিবেশী হিসেবে থাকে। একইভাবে বাংলাদেশও ভারতের সাথে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে আগ্রহী। ভবিষ্যতের দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতা অনেকটাই নির্ভর করছে এই দুই দেশের পারস্পরিক বোঝাপড়া ও সহযোগিতার উপর।
0 মন্তব্যসমূহ