প্রতি হিংসার রাজনীতি বাংলাদেশ থেকে কোন দিন বিদায় হবে কি?
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বহু দশক ধরে একটি জটিল অভিঘাতের মধ্যে দিয়ে এগিয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত নানা পর্যায়ে পরিবর্তন এসেছে, উন্নয়ন হয়েছে, নির্বাচনব্যবস্থায় সংস্কার হয়েছে, গণমাধ্যম প্রসারিত হয়েছে, কিন্তু একটি বিষাক্ত উপাদান এখনও পুরোপুরি দূর করা যায়নি— প্রতি হিংসার রাজনীতি বা রিভেঞ্জ-পলিটিক্স। এ প্রশ্নটি জনগণের মনে বারবার ফিরে আসে: এই প্রতিহিংসার রাজনীতি কি কখনো বাংলাদেশ ছেড়ে যাবে?
এই প্রশ্নের উত্তর সহজ নয়, তবে বাস্তবতা, ইতিহাস, রাজনৈতিক কাঠামো ও সমাজের আচরণ বিশ্লেষণ করলে আমরা এর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে একটি ধারণা পেতে পারি।
বাংলাদেশে প্রতিহিংসার রাজনীতির উৎপত্তি ও বিবর্তন
বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা সব সময় ছিল, কিন্তু প্রতিহিংসা হিসেবে তা প্রকট আকার ধারণ করে ষাট-সত্তরের দশকের ক্ষমতার পালাবদল, সামরিক শাসন, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ও দীর্ঘমেয়াদি বৈরিতার মাধ্যমে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অস্বাভাবিক মাত্রায় অবিশ্বাস, প্রতিপক্ষকে রাজনীতির মাঠ থেকে সরিয়ে দেওয়ার প্রবণতা এবং রাষ্ট্রযন্ত্রকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহারের ইতিহাস এই সংস্কৃতিকে আরও দৃঢ় করেছে।
পরবর্তী দশকগুলোতে নির্বাচন, আন্দোলন, সহিংসতা, গ্রেফতার, পাল্টা-আন্দোলন এবং প্রতিদিনের রাজনৈতিক ভাষ্য প্রতিহিংসাকে যেন একটি স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। জনমনে রাজনীতি একসময় আশার জায়গা হলেও, এখন তা অনেকের কাছে সংঘাতের সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রতিহিংসার রাজনীতি কেন এত শক্তিশালী হয়ে উঠেছে
১. শক্তিশালী গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অভাব
গণতন্ত্র কাগজে-কলমে থাকলেও রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় গেলে নিজেদের অবস্থান অটুট রাখতে এবং প্রতিপক্ষকে দুর্বল করার দিকে বেশি মনোযোগ দেয়। এর ফলে ক্ষমতার পালাবদল মানেই নীতি, ব্যক্তি ও প্রশাসনিক কাঠামোর ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার প্রবণতা দেখা যায়।
২. ব্যক্তিনির্ভর রাজনীতি
দলীয় নেতৃত্ব সাধারণত ব্যক্তিকেন্দ্রিক। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে নেতৃত্ব একই পরিবারের হাতে থাকছে। ফলে দলীয় বৈরিতা ব্যক্তি-বৈরিতায় রূপ নেয়।
৩. সংগঠনভিত্তিক গণতন্ত্রের ঘাটতি
দলগুলোর অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র দুর্বল। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় খুব সীমিত পর্যায়ে। এ কারণে মতের ভিন্নতা সহজেই বিদ্বেষে পরিণত হয়।
৪. সামাজিক মেরুকরণ
রাজনীতির কারণে মানুষ পরিবার, পাড়া, সমাজ—সব স্তরে ভাগ হয়ে পড়েছে। সামাজিক বিভাজন রাজনৈতিক প্রতিহিংসাকে আরও উসকে দেয়।
৫. দুর্বল বিচারব্যবস্থা ও জবাবদিহির অভাব
যে অপরাধই হোক, বিচার হয় না বা দীর্ঘসূত্রতার কারণে ফলহীন হয়ে যায়। এতে প্রতিশোধের মনোভাব বেড়ে যায় এবং প্রতিহিংসা রাজনীতির হাতিয়ারে পরিণত হয়।
এই প্রতিহিংসার রাজনীতি কি কখনো বিদায় নেবে?
হ্যাঁ, বিদায় নেওয়া সম্ভব—কিন্তু শর্তসাপেক্ষ। রাজনৈতিক সংস্কৃতি রাতারাতি বদলায় না; এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। তবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটলে বাংলাদেশ এই চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে পারে।
১. রাজনৈতিক দলগুলোর মানসিকতা পরিবর্তন
প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করা নয়; বরং রাজনৈতিক প্রতিযোগিতাকে নীতিনির্ভর করা—এমন দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠতে হবে। দলগুলোকে বিরোধী মতকে স্বীকৃতি দিতে শিখতে হবে।
২. প্রশাসন ও রাষ্ট্রযন্ত্রের নিরপেক্ষতা
যখন রাষ্ট্রযন্ত্র দলীয় স্বার্থে ব্যবহৃত হবে না, তখন প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ কমে যাবে। নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিহিংসার তীব্রতা কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
৩. বিচারব্যবস্থার সংস্কার
দ্রুত বিচার, স্বচ্ছ তদন্ত, ক্ষমতা নির্বিশেষে জবাবদিহি—এগুলো প্রতিষ্ঠা করা গেলে কেউ আর প্রতিপক্ষকে দমন করতে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করতে পারবে না।
৪. গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের ভূমিকা
স্বাধীন ও দায়িত্বশীল গণমাধ্যম রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে ইতিবাচক দিকে নিয়ে যেতে পারে। তারা সত্য প্রকাশ করবে, বিদ্বেষ নয়। নাগরিক সমাজ আলোচ্য বিষয়ে নিরপেক্ষ প্ল্যাটফর্ম হতে পারে।
৫. শিক্ষিত ও সচেতন ভোটারগোষ্ঠী
দীর্ঘমেয়াদে সাধারণ জনগণের রাজনৈতিক পরিপক্কতা বাড়লে প্রতিহিংসার রাজনীতি টিকবে না। ভোটাররাই তখন দলকে বাধ্য করবে ইতিবাচক রাজনীতিতে ফিরে যেতে।
ভবিষ্যতের আশা ও বাস্তবতা
বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় প্রতিহিংসার রাজনীতি এখনো প্রভাবশালী, তবে মানুষের মধ্যে পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা ক্রমেই বাড়ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, তরুণ প্রজন্মের মতাদর্শিক পরিবর্তন এবং বিশ্ব রাজনীতির প্রভাব আমাদের রাজনীতিকে নতুন পথে নিয়ে যেতে পারে।
প্রতিহিংসার রাজনীতি একদিন সত্যিই বিদায় নেবে—যখন সমাজ, দল, নেতৃত্ব ও প্রতিষ্ঠানগুলো মিলেমিশে একটি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরি করবে। এটি সময়সাপেক্ষ হলেও অসম্ভব নয়। জনগণের ইচ্ছাই এই পরিবর্তনের প্রধান চালিকাশক্তি।
0 মন্তব্যসমূহ