পল্লী বিদ্যুতের লোকজন কেটে ফেলছে কোটি কোটি জীবন্ত গাছ: দেখার যেন কেউ নেই
বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে আজ এক ভয়াবহ দৃশ্য চোখে পড়ে—পল্লী বিদ্যুতের নামে নির্বিচারে গাছ কাটা। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিদ্যুৎ লাইন স্থাপন, খুঁটি বসানো, তার টানার কাজের অজুহাতে প্রতিদিন কাটা হচ্ছে হাজার হাজার জীবন্ত গাছ। এই গাছগুলো কেবল কোনো কাঠ নয়, বরং প্রকৃতির শ্বাস-প্রশ্বাস, মানুষের জীবনের সঙ্গী। অথচ এই গাছগুলো নিধনের সময় যেন কারো কোন দায়বদ্ধতা নেই। যেন দেখার কেউ নেই, প্রশ্ন করারও কেউ নেই।
বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে আজ বিদ্যুতের খুঁটি, ট্রান্সফরমার, ওভারহেড লাইন স্থাপনের নাম করে গাছ কাটা এক নিয়মে পরিণত হয়েছে। যেসব গাছ বহু বছর ধরে গ্রামীণ মানুষকে ছায়া দিয়েছে, ফল দিয়েছে, পাখিদের আশ্রয় দিয়েছে, সেসব গাছ এখন বিদ্যুতের "বাধা" হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। অথচ আধুনিক যুগে বিদ্যুৎ লাইন স্থাপনে বিকল্প উপায় রয়েছে—গাছ কেটে নয়, বরং সেগুলো রক্ষা করেই অবকাঠামো নির্মাণ করা সম্ভব। কিন্তু দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষের মধ্যে সেই সচেতনতা বা ইচ্ছার অভাব স্পষ্ট।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মচারীরা স্থানীয় জনগণকে না জানিয়েই গাছ কাটার কাজ শুরু করে। অনেক সময় মালিকের অনুমতি ছাড়াই শত শত ফলজ ও বনজ গাছ কেটে ফেলা হয়। এসব গাছের মধ্যে আম, কাঁঠাল, নারকেল, মেহগনি, আকাসিয়া, বেল, শিরিষ প্রভৃতি মূল্যবান গাছও থাকে। কয়েক মিনিটের মধ্যে মোটর করাতের আওয়াজে হারিয়ে যায় এক জীবন্ত প্রাণের অস্তিত্ব। অথচ গাছগুলো রোপণে মানুষের শ্রম, সময় ও ভালোবাসার বিনিয়োগ ছিল বছরের পর বছর।
পরিবেশবিদদের মতে, বিদ্যুতায়নের নামে এই নির্বিচার গাছ কাটা দেশকে ভয়াবহ পরিবেশ সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি। গাছ কাটা মানে হলো, বাতাসের কার্বন ডাই–অক্সাইড শোষণ কমে যাওয়া, তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়া, বৃষ্টিপাতের অনিয়ম সৃষ্টি, এবং জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি। অথচ গাছের গুরুত্ব বোঝাতে বারবার নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হলেও মাঠপর্যায়ে সেই সচেতনতার প্রতিফলন দেখা যায় না।
স্থানীয় প্রশাসন ও বন বিভাগের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। গাছ কাটার সময় অনেকে অভিযোগ করে যে, বন বিভাগের কর্মকর্তারা কোনো ব্যবস্থা নেয় না। বরং কিছু ক্ষেত্রে তারা বিষয়টি “বিদ্যুৎ উন্নয়ন কাজ” বলে এড়িয়ে যান। এতে করে যারা গাছ কেটে ফেলছে, তারা আরও সাহসী হয়ে উঠছে। যেন এই দেশে গাছের কোনো মালিকানা নেই, পরিবেশের কোনো মূল্য নেই।
আইন অনুযায়ী, কোনো সরকারি বা বেসরকারি সংস্থা গাছ কাটতে চাইলে যথাযথ অনুমোদন নিতে হয়। কিন্তু বাস্তবে এই আইন কার্যকরভাবে প্রযোজ্য হচ্ছে না। গাছ কাটার ক্ষতিপূরণ বা বিকল্প হিসেবে নতুন গাছ রোপণের পরিকল্পনাও সচরাচর দেখা যায় না। কিছু এলাকায় মানুষ স্বেচ্ছায় গাছ লাগায়, কিন্তু সেই গাছ বড় হওয়ার আগেই বিদ্যুতের কাজের নামে কেটে ফেলা হয়—যা একধরনের মনোবল ভেঙে দেওয়া কাজ।
অন্যদিকে, পল্লী বিদ্যুতের কর্মকর্তারা দাবি করেন, তারা বাধ্য হয়েই গাছ কাটেন, কারণ বিদ্যুৎ লাইনের নিরাপত্তা বজায় রাখতে গাছের শাখা-প্রশাখা দূর করা প্রয়োজন। কিন্তু প্রশ্ন হলো—গাছ কাটা ছাড়া কি কোনো বিকল্প নেই? প্রযুক্তির অগ্রগতির এই যুগে আন্ডারগ্রাউন্ড কেবল স্থাপন বা নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে লাইন বসানো সম্ভব নয়? আসলে এটি কেবল দায়িত্বহীনতার চিত্র, যেখানে দ্রুত কাজ শেষ করার তাড়নায় প্রকৃতির ক্ষতি উপেক্ষা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে গাছ কেবল সৌন্দর্যের প্রতীক নয়, এটি গ্রামীণ অর্থনীতিরও অংশ। গাছ থেকে মানুষ কাঠ, ফল, ওষুধ, এমনকি জীবিকার উপকরণ পায়। গাছ রক্ষা মানে মানুষ ও প্রকৃতিকে একসঙ্গে টিকিয়ে রাখা। কিন্তু পল্লী বিদ্যুতের নির্বিচার গাছ কাটা সেই ভারসাম্যকে ধ্বংস করছে। আজ সময় এসেছে সরকার, স্থানীয় প্রশাসন, ও সাধারণ মানুষকে একত্রে দাঁড়ানোর।
যদি এখনই এই ধ্বংসযজ্ঞ বন্ধ না হয়, তবে আগামী প্রজন্ম হয়তো শুধুমাত্র বইয়ের পাতায় গাছ দেখতে পাবে। আমাদের চারপাশে থাকবে তারের জাল, ধুলায় ঢাকা মাটি, আর তীব্র গরমের দগদগে বাস্তবতা। বিদ্যুৎ উন্নয়ন অবশ্যই দরকার, কিন্তু তার বিনিময়ে যদি প্রকৃতিকে হত্যা করতে হয়—তাহলে সেই উন্নয়ন টেকসই নয়।
গাছ বাঁচাও মানেই জীবন বাঁচাও। বিদ্যুৎ দরকার, কিন্তু প্রকৃতি ছাড়া বিদ্যুৎও অর্থহীন। এখনই সময়—পল্লী বিদ্যুতের নির্বিচার গাছ কাটা বন্ধ করে সবুজ বাংলাদেশ গড়ার। 🌳

0 মন্তব্যসমূহ